বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল

undefined


বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বাংলাদেশের একটি প্রধান রাজনৈতিক দল। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এই দল প্রতিষ্ঠা করেন। ৩০ এপ্রিল ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান তার শাসনকে বেসামরিক করার উদ্দেশ্য ১৯ দফা কর্মসূচি শুরু করেন। জেনারেল জিয়া যখন সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি রাষ্ট্রপতির পদের জন্য নির্বাচন করবেন তখন তার নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রীক দল (জাগদল) প্রতিষ্ঠিত হয়। এই দলের সমন্বয়ক ছিলেন বিচারপতি আব্দুস সাত্তার।

প্রতিষ্ঠা

জাতীয় সংসদ নির্বাচন এগিয়ে আসলে জিয়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল গঠন করেন। জাগদলকে বিএনপির সাথে একীভূত করা হয়। রাষ্ট্রপতি জিয়া এই দলের সমন্বয়ক ছিলেন এবং এই দলের প্রথম চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী এর প্রথম মহাসচিব ছিলেন। জিয়ার এই দলে বাম, ডান, মধ্যপন্থি সকল প্রকার লোক ছিলেন। বিএনপির সবচেয়ে প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল এর নিয়োগ পদ্ধতি। প্রায় ৪৫ শতাংশ সদস্য শুধুমাত্র রাজনীতিতে যে নতুন ছিলেন তাই নয়, তারা ছিলেন তরুণ। [১]১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিকাল ৫টায় রমনা রেস্তোরাঁয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রতিষ্ঠাতা তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র পাঠের মাধ্যমে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের যাত্রা শুরু করেন। জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তিনি ঘোষণাপত্র পাঠ ছাড়াও প্রায় দুই ঘণ্টা সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। সংবাদ সম্মেলনে নতুন দলের আহ্বায়ক কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি প্রথমে ১৮ জন সদস্যের নাম এবং ১৯ সেপ্টেম্বর ওই ১৮ জনসহ ৭৬ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেন। এখানে উল্লেখ্য, বিএনপি গঠন করার আগে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) নামে আরেকটি দল তৎকালীন উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে সভাপতি করে গঠিত হয়েছিল। ২৮ আগস্ট ১৯৭৮ সালে নতুন দল গঠন করার লহ্ম্য জাগদলের বর্ধিত সভায় ওই দলটি বিলুপ্ত ঘোষণার মাধ্যমে দলের এবং এর অঙ্গ সংগঠনের সকল সদস্য জিয়াউর রহমান ঘোষিত নতুন দলে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় । নিচে দলের প্রথম আহ্বায়ক কমিটির পূর্ণাঙ্গ তালিকা দেয়া হলো :
আহ্বায়ক : জিয়াউর রহমান। সদস্য : ১. বিচারপতি আবদুস সাত্তার ২. মশিউর রহমান যাদু মিয়া ৩. মোহাম্মদ উল্লাহ ৪. শাহ আজিজুর রহমান ৫. ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল হালিম চৌধুরী ৬. রসরাজ মন্ডল ৭. আবদুল মোনেম খান ৮. জামাল উদ্দিন আহমেদ ৯. ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ১০. মির্জা গোলাম হাফিজ ১১. ক্যাপ্টেন (অব.) নুরুল হক ১২. এম. সাইফুর রহমান ১৩. ওবায়দুর রহমান ১৪. মওদুদ আহমদ ১৫. শামসুল হুদা চৌধুরী ১৬. এ জেড এম এনায়েতউল্লাহ খান ১৭. এসএ বারী এটি ১৮. ড. আমিনা রহমান ১৯. আবদুর রহমান ২০. ডা. এম এ মতিন ২১. আবদুল আলিম ২২. ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত ২৩. আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ২৪. নুর মোহাম্মদ খান ২৫. আবদুল করিম ২৬. শামসুল বারী ২৭. মুজিবুর রহমান ২৮. ডা. ফরিদুল হুদা ২৯. শেখ আলী আশরাফ ৩০. আবদুর রহমান বিশ্বাস ৩১. ব্যারিস্টার আবদুল হক ৩২. ইমরান আলী সরকার ৩৩. দেওয়ান সিরাজুল হক ৩৪. এমদাদুর রহমান ৩৫. এডভোকেট আফসার উদ্দিন ৩৬. কবীর চৌধুরী ৩৭. ড. এম আর খান ৩৮. ক্যাপ্টেন (অব.) সুজাত আলী ৩৯. তুষার কান্তি বারবি ৪০. সুনীল গুপ্ত ৪১. রেজাউল বারী ডিনা ৪২. আনিসুর রহমান ৪৩. আবুল কাশেম ৪৪. মনসুর আলী সরকার ৪৫. আবদুল হামিদ চৌধুরী ৪৬. মনসুর আলী ৪৭. শামসুল হক ৪৮. খন্দকার আবদুল হামিদ ৪৯. জুলমত আলী খান ৫০. এডভোকেট নাজমুল হুদা ৫১. মাহবুব আহমেদ ৫২. আবু সাঈদ খান ৫৩. মোহাম্মদ ইসমাইল ৫৪. সিরাজুল হক মন্টু ৫৫. শাহ বদরুল হক ৫৬. আবদুর রউফ ৫৭. মোরাদুজ্জামান ৫৮. জহিরুদ্দিন খান ৫৯. সুলতান আহমেদ চৌধুরী ৬০. শামসুল হুদা ৬১. সালেহ আহমেদ চৌধুরী ৬২. আফসার আহমেদ সিদ্দিকী ৬৩. তরিকুল ইসলাম ৬৪. আনোয়ারুল হক চৌধুরী ৬৫. মাইনুদ্দিন আহমেদ ৬৬. এমএ সাত্তার ৬৭. হাজী জালাল ৬৮. আহমদ আলী মন্ডল ৬৯. শাহেদ আলী ৭০. আবদুল ওয়াদুদ ৭১. শাহ আবদুল হালিম ৭২. জমির উদ্দিন সরকার ৭৩. আতাউদ্দিন খান ৭৪. আবদুর রাজ্জাক চৌধুরী ৭৫. আহমদ আলী। [২]

মূলনীতি

বিএনপির লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিক উন্নয়ন, গণতন্ত্রায়ন, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য এবং জনগণের মধ্যে স্ব-নির্ভরতার উত্থান ঘটানো। এগুলোর ভিত্তিতে জিয়াউর রহমান তার ১৯-দফা ঘোষণা করেন। বিএনপির রাজনীতির মূল ভিত্তি ছিল-
১. সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌র উপর বিশ্বাস,
২. জাতীয়তাবাদ,
৩. গণতন্ত্র,
৪. সমাজতন্ত্র (অর্থনৈতিক ও সমাজিক ন্যায়বিচারের অর্থে)।

দলীয় স্লোগান

শহীদ জিয়া অমর হউক।
বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য

জাতীয়তাবাদী দলের ঘোষণাপত্রে এ দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিস্তৃতভাবে বর্ণিত হয়েছে। সংক্ষেপে এ দলের কয়েকটি মৌলিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিচে বর্ণিত হলোঃ
(ক) বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ-ভিত্তিক ইস্পাতকঠিন গণঐক্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা, রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা ও গণতন্ত্র সুরক্ষিত ও সুসংহত করা। (খ) ঐক্যবদ্ধ এবং পুনরুজ্জীবিত জাতিকে অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভরতার মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ, নয়া-উপনিবেশবাদ, আধিপত্যবাদ ও বহিরাক্রমণ থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করা। (গ) উৎপাদনের রাজনীতি, মুক্তবাজার অর্থনীতি এবং জনগণের গণতন্ত্রের মাধ্যমে সামাজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক মানবমুখী অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জাতীয় সমৃদ্ধি অর্জন। (ঘ) জাতীয়তাবাদী ঐক্যের ভিত্তিতে গ্রামে-গঞ্জে জনগণকে সচেতন ও সুসংগঠিত করা এবং সার্বিক উন্নয়নমুখী পরিকল্পনা ও প্রকল্প রচনা ও বাস্-বায়নের ক্ষমতা ও দক্ষতা জনগণের হাতে পৌঁছে দেওয়া। (ঙ) এমন এক সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করা যেখানে গণতন্ত্রের শিকড় সমাজের মৌলিক স্-রে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয়। (চ) এমন একটি সুস্পষ্ট ও স্থিতিশীল সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার নিশ্চিতি দেওয়া যার মাধ্যমে জনগণ নিজেরাই তাঁদের মানবিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতি আনতে পারবেন। (ছ) বহুদলীয় রাজনীতির ভিত্তিতে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত একটি সংসদীয় পদ্ধতির সরকারের মাধ্যমে স্থিতিশীল গণতন্ত্র কায়েম করা এবং সুষম জাতীয় উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি আনয়ন। (জ) গণতান্ত্রিক জীবন ধারা ও গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থার রক্ষাকবচ হিসাবে গণনির্বাচিত জাতীয় সংসদের ভিত্তি দৃঢ়ভাবে স্থাপন করা এবং জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা। (ঝ) রাজনৈতিক গোপন সংগঠনের তৎপরতা এবং কোন সশস্ত্র ক্যাডার, দল বা এজন্সী গঠনে অস্বীকৃতি জানানো ও তার বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করা। (ঞ) জাতীয় জীবনে মানবমুখী সামাজিক মূল্যবোধের পুনরুজ্জীবন এবং সৃজনশীল উৎপাদনমুখী জীবনবোধ ফিরিয়ে আনা। (ট) বাস্-বধর্মী কার্যকরী উন্নয়ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জাতীয় জীবনে ন্যায়বিচার-ভিত্তিক সুষম অর্থনীতির প্রতিষ্ঠা, যাতে করে সকল বাংলাদেশী নাগরিক অন্ন, বস্ত্র, স্বাস্থ্য, বাসস্থান ও শিক্ষার ন্যূনতম মানবিক চাহিদা পূরণের সুযোগ পায়। (ঠ) সার্বিক পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচীকে অগ্রাধিকার দান করা ও সক্রিয় গণচেষ্টার মাধ্যমে গ্রাম বাংলার সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা। (ড) নারী সমাজ ও যুব সম্প্রদায়সহ সকল জনসম্পদের সুষ্ঠু ও বাস্-বভিত্তিক সদ্ব্যবহার করা। (ঢ) বাস্-বধর্মী অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ এবং সুসামঞ্জস্যপূর্ণ শ্রম ব্যবস্থাপনা সম্পর্ক স্থাপন এবং সুষ্ঠু শ্রমনীতির মাধ্যমে শিল্পক্ষেত্রে সর্বোচ্চ উৎপাদন নিশ্চিত করা। (ণ) বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, বাংলাদেশের সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও বাংলাদেশের ক্রীড়া সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও প্রসার সাধন। (ত) বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশী জনগণের ধর্ম ইসলাম এবং অন্যান্য ধর্মীয় শিক্ষার সুযোগ দান করে বাংলাদেশের জনগণের যুগপ্রাচীন মানবিক মূল্যবোধ সংরক্ষণ করা, বিষে করে অনগ্রসর সম্প্রদায়ের জন্য শিক্ষা সম্প্রসারণ ও বৃহত্তর জাতীয় তাদের অধিকতর সুবিধা ও অংশগ্রহণের সুযোগের যথাযথ ব্যবস্থা করা। (থ) পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে জোট নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে আন্-র্জাতিক বন্ধুত্ব, প্রীতি ও সমতা রক্ষা করা। সার্বভৌমত্ব ও সমতার ভিত্তিতে প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে, তৃতীয় বিশ্বের মিত্র রাষ্ট্রসমূহের সাথে এবং ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে প্রীতি ও সখ্যতার সম্পর্ক সুসংহত এবং সুদৃঢ় করা।

সাংগঠনিক কাঠামো

জাতীয়তাবাদী দল দেশের মৌলিক স্তর গ্রাম/ওয়ার্ড পর্যায় থেকে সংগঠিত হয়ে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত সম্প্রসারিত। দলের সাংগঠনিক কাঠামো নিম্নরূপঃ (১) গ্রাম কাউন্সিল ও গ্রাম নির্বাহী কমিটি (২) শহর/পৌরসভা ওয়ার্ড কাউন্সিল ও শহর/পৌরসভা ওয়ার্ড নির্বাহী কমিটি (৩) ইউনিয়ন কাউন্সিল ও ইউনিয়ন নির্বাহী কমিটি (৪) থানা কাউন্সিল ও থানা নির্বাহী কমিটি (৫) শহর/পৌরসভা কাউন্সিল ও শহর পৌরসভা নির্বাহী কমিটি (৬) জেলা কাউন্সিল ও জেলা নির্বাহী কমিটি (৭) নগর/ওয়ার্ড কাউন্সিল ও নগর ওয়ার্ড নির্বাহী কমিটি (৮) নগর থানা কাউন্সিল ও নগর থানা নির্বাহী কমিটি (৯) নগর কাউন্সিল ও নগর নির্বাহী কমিটি (১০) জাতীয় কাউন্সিল (১১) জাতীয় নির্বাহী কমিটি (১২) জাতীয় স্থায়ী কমিটি (১৩) পার্লামেন্টারী বোর্ড (১৪) পার্লামেন্টারী পার্টি (১৫) বিদেশে দলের শাখা

জাতীয় ঐক্য

বিএনপি গঠনের শুরুতে দেশে বিভিন্ন ভাবে বিভক্ত ছিল। এই বিভক্তির ভিত্তি ছিল রাজনৈতিক বিশ্বাস (বাম, ডান, মধ্যপন্থি), মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের ও বিপক্ষের শক্তি ইত্যাদি। এর ফলশ্রুতিতে ছাত্র-শিক্ষক, বুদ্ধজীবী, পেশাজীবি, সাংস্কৃতিক কর্মী, সামরিক বাহিনী এমনকি প্রশাসনও বিভক্ত ছিল। বিএনপি প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি ছিল এই সকল বিভেদ ভুলে সকলে মিলে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। জিয়ার সময়ই আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা, শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর প্রথম দেশে আসেন এবং আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেই সাথে জামায়াতে ইসলামীও এই সময় রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠে। তাদের বহু নেতা যারা মুক্তিযুদ্ধের পর দেশের বাইরে ছিল তারা দেশে আসার অনুমতি লাভ করে। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তি শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারি সকল দল ও ব্যক্তির জন্য ক্ষমা ঘোষণা করেন। তবে, যাদের বিরুদ্ধে সরাসরি হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নি সংযোগ ও লুটপাট এই চারটি অভিযোগ থাকবে তারা এই ক্ষমার আওতায় পরে নাই। যদিও, এদের বিরুদ্ধে তেমন কোন ব্যাপক ও কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়ার উদাহরণ নেই।

পররাষ্ট্রনীতি

শুরু থেকেই বিএনপির লক্ষ্য ছিল জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা। স্বাধীনতা পরবর্তি সরকারের ভারত-ঘেষা পররাষ্ট্রনীতির ফলে বাংলাদেশ আন্তর্জার্তিক অঙ্গনে ভারত-সোভিয়েত অক্ষের দিকে চলে যায়, ফলে বাংলাদেশের অন্যান্য বিশ্বশক্তির সাথে সম্পর্ক তেমন ভাল ছিল না। বিএনপি তার পররাষ্ট্রনীতিতে নিরপেক্ষতা ধারণ করে।

সরকার গঠন

স্বাধীন বাংলাদেশে সবথেকে বেশী সময় রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। ১৯৯০ এর গণতন্ত্রায়নের পর দেশের মোট চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি মোট দুইটিতে জয়লাভ করে। ১৯৯১ এর সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি ১৪২ টি আসন লাভ করে। তারা জামায়তে ইসলামীর সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে। ফলশ্রুতিতে বিএনপি সংরক্ষিত ৩০ টি মহিলা আসনের ২৮টি নিজেরা রেখে বাকি ২টি জামায়াতকে দিয়ে দেয়। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-সহ চারদল প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়লাভ করে।

জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সরকার

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনা সদস্যদের গুলিতে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর প্রায় তিন বছর পর্যন্ত বাংলাদেশ শাসিত হয় অনির্বাচিত সরকার দ্বারা। সে সময় দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেন তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। তিনি রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ২৯৮টি আসনের মধ্যে ২০৭টিতে জয়লাভ করে। নির্বাচনে অংশ নিয়ে মালেক উকিলের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ৩৯টি ও মিজানুর রহমান চৌধুরির নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ২টি আসনে জয়লাভ করে। এছাড়া জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ৮টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ১টি ও মুসলিম ডেমোক্রেটিক লীগ ২০টি আসনে জয়লাভ করে। ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র দুই বছরের মাথায় জিয়াউর রহমান আততায়ীর হামলায় নিহত হলে তৎকালীন উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি হন। পরে ১৯৮৩ সালে সাত্তারকে সরিয়ে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রপতি হন।

বিচারপতি আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বে সরকার

খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে প্রথম সরকার (পঞ্চম জাতীয় সংসদ)

সর্বস্তরের জনতার বিক্ষোভ জনসমুদ্রে পরিণত হলে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পদত্যাগে বাধ্য হন। তিন দফা রূপরেখা অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনে বিএনপি সর্বাধিক আসনে জয়লাভ করে। এ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে প্রথমবারের মতো গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়। এ সরকার পাঁচ বছর দেশ শাসনের পর ক্ষমতা হস্তান্তর ছাড়াই ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করে। এ নির্বাচন আওয়ামী লীগ বয়কট করায় একই বছর ১২ জুন অনুষ্ঠিত হয় সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসা এ দলটির হয়ে প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা।

খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দ্বিতীয় সরকার (ষষ্ট জাতীয় সংসদ)

১৯৯৬ সালের ১৫ ই ফেব্রুয়ারি বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ১৯৯১ সালের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত গণতন্ত্রকে অনেকটা হুমকির সম্মুখে ঢেলে একদলীয় নির্বাচন করে ২য় বারের মত সরকার গঠন করে। এই সরকারের মেয়াদ ছিল মাত্র ৪৫ দিন।

খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে তৃতীয় সরকার (অষ্টম জাতীয় সংসদ)

২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে।মোট ২১০টি আসন নিয়ে চারদলীয় ঐক্যজোট ক্ষমতায় যায়। এই সময়ে চাপাইনবাবগন্জের কানসাট এ বিদ্যুতের দাবিতে আন্দোলনে পুলিশের নির্মম হত্যাযজ্ঞে ১০ জনের অধিক গ্রামবাসী হত্যা, ঢাকার শণির আখড়ার বিদ্যুৎ ও পানির দাবিতে সাধারণ জনতার আন্দোলন, এর মত কয়েকটি আন্দোলন হয়। এছাড়া ও সরকারী ত্রাণ তাহবিল থেকে ত্রাণ সামগ্রী সরকারীদলের সাংসদদের লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এ সরকারের বৈধ মেয়াদ ২০০৬ সালের ৬ অক্টোবর শেষ হওয়ার পর ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে দেশে শুরু হয় ব্যাপক রাজনৈতিক সংঘাত। পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি সারাদেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন। আর এ সময় থেকে গত ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় দুই বছর দেশ পরিচালনা করেন ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এ সরকারের তত্ত্বাবধানে ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৩০ আসন নিয়ে জয়লাভ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এ নির্বাচনে মাত্র ২৯টি আসন পায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং ২৭টি আসনে জয়লাভ করে জাতীয় পার্টি।

আন্দোলন

জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু সেনাপ্রধান এরশাদ তাকে ক্ষমতা চুত্য করে দেশে সামরিক শাসন জারি করে। বিএনপি এই ক্ষমতা গ্রহণকে প্রত্যাখ্যান করে এবং এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। প্রায় ৯ বছর আন্দোলন করে বিএনপি সহ সকল রাজনৈতিক দল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে ক্ষমতা চুত্য করে। এরপর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি সরকার গঠন করে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ই ফেব্রুয়ারি বিএনপি একটি একদলীয় নির্বাচনের করেন এবং গণআন্দোলনের মুখে পুনরায় একটি নির্দলীয় তত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা দিয়ে সকল দলের অংশগ্রহণে পুনরায় নির্বাচনে যোগ দিলে বিএনপি নির্বাচনে পরাজিত হয় এবং দেশের বৃহত্তম বিরোধীদল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত বিএনপি আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। এ আন্দোলন তেমন সফল না হলেও ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে নির্বাচিত হয়।

এরশাদ বিরোধী আন্দোলন

আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন

জোট গঠন

চারদলীয় জোট গঠন

২০০১ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি এবং ইসলামী ঐক্য জোট মিলিত হয়ে চার-দলীয় ঐক্য জোট গঠন করে। কিন্তু কিছু দিন পরেই জাতীয় পার্টির একটি অংশ এরশাদের নেতৃত্বে দল থেকে বের হয়ে যায়। কিন্তু নাজিউর রহমান মঞ্জুর সমর্থক অংশটি জোটে থেকে যায়।

আঠারো দলীয় জোট গঠন

২০১২ সালের ১৮ই এপ্রিল বিএনপি আরও রাজনৈতিক দলের সাথে একীভূথ হয়ে ১৮ দলীয় জোট গঠন করে। এই জোটে বিএনপির শরিক হিসাবে রয়েছে চার দলের জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, খেলাফত মজলিশ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম। নতুন যোগ হয়েছে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), কল্যাণ পার্টি, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি), বাংলাদেশ লেবার পার্টি, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি), বাংলাদেশ ন্যাপ, মুসলিম লীগ, ইসলামিক পার্টি, ন্যাপ ভাসানী, ডেমোক্রেটিক লীগ (ডিএল) ও পিপলস লীগ।[৬]

বর্তমান নেতৃত্ব

বর্তমানে বিএনপির নেতৃত্বে আছেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়া। বেগম জিয়া বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী। প্রতিবার নির্বাচনে তিনি পাঁচটি আসনে নির্বাচন করে জয়ী হয়েছেন। ২০০৭ সাল থেকে সাবেক সংসদীয় হুইপ ও জেষ্ঠ্য নেতা খন্দকার দেলোয়ার হোসেন দলের মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ম পালন করে আসছিলেন। কিন্তু ২০১১ সালের মার্চে তিনি বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করার পর জেষ্ঠ্য যুগ্ম মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে দলের মহাসচিবের ভার দেয়া হয়। মির্জা ফখরুল বর্তমানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ম পালন করছেন।